কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্যাঞ্চলে যে কয়টি প্রাকৃতিক বন রয়েছে তার মধ্যে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান অন্যতম। উঁচ-নিচু পাহাড়, নদী ও হ্রদ নিয়ে উদ্যানটি ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক ৫,৪৬৪ হেক্টর বা ১৩ হাজার ৫০০ একর জায়গা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়।১৮৭৩ সালে এখানে প্রথম প্রাকৃতিক বন কেটে কৃত্রিমভাবে বনায়ন শুরু হয়, যা ভারত উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরনো সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি।১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনের আওতায় ১৯৯৯ সালে এটি
জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা পায়। এর আগে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান সীতাপাহাড় সংরক্ষিত বনের অংশ ছিল। এই উদ্যানে ১৮৭৩, ১৮৭৮ এবং ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে বৃক্ষায়ন করা হয়েছিল, আর তারই ফলশ্রুতিতে এখানে গড়ে উঠেছিল একটি ক্রান্তীয় রেইন ফরেস্ট।নয়নাভিরাম সবুজ বন, এঁকেবেঁকে বয়ে চলা কর্ণফুলী নদী, কাপ্তাই হ্রদ এ উদ্যানের প্রধান আকর্ষণ। প্রাকৃতিক অনাবিল সৌন্দর্যের কারণে এ উদ্যানটি বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মিঠাপানির কৃত্রিম হ্রদ ছাড়াও এখানে রয়েছে কাপ্তাই পানি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও কর্ণফুলী পেপার মিল।
পাহাড়ে ঘেরা উপমহাদেশের যে কটি প্রাচীন উদ্যান আছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৫৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে এ বনের অবস্থান। আর রাঙ্গামাটি শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। এ এলাকার ভৌগলিক অবস্থানঃ ২২°১৮′০৩″উত্তর ৯২°০৭′১৩″পূর্ব
কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে রামপাহাড় ও সীতাপাহাড়। দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে কর্ণফুলী নদী। এখানকার ছোট-বড় পাহাড়ের গা বেয়ে বেড়ে ওঠা মিশ্র চিরসবুজ বনের বৃক্ষগুলো বন্যপ্রাণিদের নিরাপদ আবাসস্থল।
পাহাড়ের ঢালে ঢালে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। নানা রকম গাছপালা সমৃদ্ধ এ উদ্যানে আছে-- সেগুন, চাপালিশ, গর্জন, তেলশুর,জারুল, ছাতিম , চম্পা, সোনালু, চালতা, চিকরাশি, শাল, শিলকড়ই, ধারমারা, গামারি, অর্জুন, আমলকি, আমড়া, বহেরা, বাজনা, বড়ই, পিটরাজ, পিটাল, বাঁশপাতা, বৈলাম, নাগেশ্বর, হিজল, উদল, উরিয়া, লোহাকাঠ ইত্যাদি।বড় বড় বৃক্ষ ছাড়াও এখানে রয়েছে বুনো অর্কিড ও নানা প্রজাতির লতা-গুল্ম। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ। এসব গাছপালার ছায়ার নিচ দিয়ে আঁকাবাঁকা পায়েচলা পথে হাঁটলে মন হারিয়ে যাবে অজানায়।
বৈচিত্র্যময় বন্যপ্রাণীরতে সমৃদ্ধ এ বনাঞ্চল।এখানেই দেখা মিলবে ডাঙ্গার সবচেয়ে বড় প্রাণী বন্যহাতির।
দলবেঁধে হাতিরা বনের ভেতরে ঘুরে বেড়ায় অবাধে। কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের স্তন্যপায়ী প্রাণী মধ্যে আছে বাঁদুড়, বেজি, কাঠবিড়ালি, হরিণ, শেয়াল,হনুমান, উল্লুক, শুকর, বনবিড়াল, গুইশাপ, অজগর ইত্যাদির পদচারণায় মুখর থাকে এ বন। ভাগ্য ভালো থাকলে বিশ্বের অন্যতম বড় বিষধর সাপ শঙ্খচুরের দেখা পেয়ে যেতে পারেন। বিভিন্ন প্রজাতির পাখপাখালির নিরাপদ বিচরণ ক্ষেত্র এই জঙ্গল। ধনেশ, ফিঙ্গে, বুলবুলি, কাঠময়ূর, বনমোরগ, ময়না, ঘুঘু, টিয়া, মাছারাঙ্গাসহ নানান ধরনের পাখির দেখা মিলবে গাছের ডালে, ঝোপের আড়ালে। তবে তাদের দেখতে চাইলে ঠোঁটে কুলুপ এঁটে চলতে হবে বনের পথে। ঋতু ভেদে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে এ মিশ্র চিরসবুজ বন। বেশকিছু দুর্লভ প্রজাতির ব্যাঙেরও দেখা মেলে এখানে। এছাড়া সরীসৃপ প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গিরগিটি, তক্ষক ও সাপ। মনের ভালোলাগা বাড়িয়ে দিতে এ উদ্যানে ওড়াউড়ি করে বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি। রসনা তৃপ্তির জন্য রয়েছে কাপ্তাই লেক ও কর্ণফুলীর ছোট-বড় মাছ। দেখা মিলবে এ উদ্যানে।
বন এলাকা ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির আওতায় বেশ কয়েকটি পর্যবেক্ষণস্থান আর পায়েহাঁটা পথ তৈরি করা হয়েছে এ বনে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও উল্লেখযোগ্য পথটি হল ব্যাঙছড়ির মাঝারি বনপথ। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়কের ব্যাঙছড়ি মারমাপাড়া থেকে শুরু হওয়া বনের ভেতর পথটির দৈর্ঘ্য আড়াই কিলোমিটারের একটু কম। এ পথেই জীববৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশি। রয়েছে বেশ কয়েকটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র এবং টাওয়ার। উঁচুনিচু পাহাড়ি এ পথে আরও আছে ছোটবড় কয়েকটি ঝরনা।
কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান এলাকায় আছে মারমা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের দুটি গ্রাম। একটি ব্যাঙছড়ি মারমাপাড়া অন্যটি চিৎমুরং বড়পাড়া। এসব গ্রামে দেখতে পাবেন তাদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা। তবে গ্রামে প্রবেশের আগে অবশ্যই কারবারি বা হেডম্যানের অনুমতি নিয়ে নিতে হয়।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন কিংবা আকাশপথে চট্টগ্রাম আসতে হবে। এখানে বহদ্দারহাট বাস স্টেশন থেকে পনের মিনিট পরপর বাস ছেড়ে যায় কাপ্তাই এর উদ্দেশ্যে। পৌঁছাতে সময় লাগে দেড়-দুই ঘন্টা। ভাড়া ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকা থেকে সরাসরি কাপ্তাই যায় ডলফিন, সৌদিয়া, এস আলম, শ্যামলী পরিবহনের বাস। ঢাকার কলাবাগান, ফকিরাপুল ও সায়দাবাদ থেকে এসব বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা।
থাকবেন যেখানে
থাকার জন্য রয়েছে সাধারণমানের কিছু হোটেল। কাপ্তাই শহরের এসব হোটেলগুলো হল- হোটেল থ্রি স্টার, হোটেল নিরাপদ, বোয়ালখালি বোর্ডিং, কামাল বোর্ডিং ইত্যাদি। ২০০ থেকে ৬০০ টাকায় দুইজন থাকার কক্ষ আছে। এ ছাড়া বন বিভাগের রেস্ট হাউজে থাকতে হলে পূর্বানুমতির প্রয়োজন হবে। কাপ্তাই এলাকায় খাবার জন্য সাধারণ মানের বেশ কিছু রেঁস্তোরা আছে। সবচেয়ে ভালো খাবারের জন্য বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ঝুম রেঁস্তোরা উৎকৃষ্ট।
জঙ্গল ভ্রমণে করণীয়
সবসময় হালকা কাপড় পরবেন। পোশাকের রংও হবে হালকা। পায়ে পরবেন জুতা। রোদচশমা, রোদটুপি, ছাতা, পানির বোতল সঙ্গে নেবেন। বর্ষায় ভ্রমণে গেলে অবশ্যই ছাতা বা রেইনকোট সঙ্গে নিন। পোকামাকড় আর মশার হাত থেকে বাঁচতে পতঙ্গনাশক ক্রিম নিতে ভুলবেন না। জঙ্গলে বর্ষায় জোঁকের উপদ্রব বাড়ে। তাই জোঁক থেকে বাঁচতে মোজার মধ্যে প্যান্ট গুঁজে নিন। দূরের বন্যপ্রাণী আর পাখি দেখতে দুরবিন নিতে পারেন। জঙ্গলে ভ্রমণের সময় যথাসম্ভব চুপচাপ থাকার চেষ্টা করুন। বেশি আওয়াজে বন্যপ্রাণীরা বিরক্ত হয়। তখন তাদের দেখা পাওয়া কঠিন হবে। প্লাস্টিক জাতীয় প্যাকেট, বোতল, ক্যান সঙ্গে আনলে সেগুলো বনে ফেলে পরিবেশ নষ্ট করবেন না। সঙ্গে করে বাইরে এনে ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলুন।
জঙ্গলে যা করবেন না
পিকনিক করতে জঙ্গলে যাবেন না। ভ্রমণে উচ্চশব্দে বা মাইকে গান কিংবা কোনোকিছু বাজাবেন না। বন্যপ্রাণীরা বিরক্ত হয় এমন কোনো শব্দ কিংবা আওয়াজ করবেন না। ময়লা, প্লাস্টিক জাতীয় কোন কিছু জঙ্গলে ফেলবেন না। বনে ধূমপান করবেন না।
বন্যপ্রাণীদের জন্য কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান দেশের অন্যতম আবাসস্থল হলেও বৈরী জলবায়ুর চেয়ে মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের কারণে বনের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, অধিক বনজসম্পদ আহরণ, জুম চাষ, বন্যপ্রাণী শিকার এর মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছপালা কেটে সেখানে বাণিজ্যিকভিত্তিতে আগর বাগান করার কারণেও বন্যপ্রাণীরা তাদের আবাসস্থল হারাচ্ছে। সংকুচিত হয়ে পড়ছে তাদের বিচরণ এলাকা। পাশাপাশি কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান এলাকার বিভিন্ন স্থানে মানববসতি গড়ে ওঠায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক জীবনধারা। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেই কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান পর্যটকদের কাছে পরিচিত একটি স্থান। এ উদ্যানের সৌন্দর্য অটুট রাখতে এলাকার মানুষের ভেতর সচেতনতা বাড়াতে হবে। পর্যটকদের পরিবেশবিরোধী কার্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখতে হবে এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্যাঞ্চলে যে কয়টি প্রাকৃতিক বন রয়েছে তার মধ্যে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান অন্যতম। উঁচ-নিচু পাহাড়, নদী ও হ্রদ নিয়ে উদ্যানটি ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক ৫,৪৬৪ হেক্টর বা ১৩ হাজার ৫০০ একর জায়গা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়।১৮৭৩ সালে এখানে প্রথম প্রাকৃতিক বন কেটে কৃত্রিমভাবে বনায়ন শুরু হয়, যা ভারত উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরনো সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি।১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনের আওতায় ১৯৯৯ সালে এটি
জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা পায়। এর আগে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান সীতাপাহাড় সংরক্ষিত বনের অংশ ছিল। এই উদ্যানে ১৮৭৩, ১৮৭৮ এবং ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে বৃক্ষায়ন করা হয়েছিল, আর তারই ফলশ্রুতিতে এখানে গড়ে উঠেছিল একটি ক্রান্তীয় রেইন ফরেস্ট।নয়নাভিরাম সবুজ বন, এঁকেবেঁকে বয়ে চলা কর্ণফুলী নদী, কাপ্তাই হ্রদ এ উদ্যানের প্রধান আকর্ষণ। প্রাকৃতিক অনাবিল সৌন্দর্যের কারণে এ উদ্যানটি বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মিঠাপানির কৃত্রিম হ্রদ ছাড়াও এখানে রয়েছে কাপ্তাই পানি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও কর্ণফুলী পেপার মিল।
পাহাড়ে ঘেরা উপমহাদেশের যে কটি প্রাচীন উদ্যান আছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৫৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে এ বনের অবস্থান। আর রাঙ্গামাটি শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। এ এলাকার ভৌগলিক অবস্থানঃ ২২°১৮′০৩″উত্তর ৯২°০৭′১৩″পূর্ব
কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে রামপাহাড় ও সীতাপাহাড়। দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে কর্ণফুলী নদী। এখানকার ছোট-বড় পাহাড়ের গা বেয়ে বেড়ে ওঠা মিশ্র চিরসবুজ বনের বৃক্ষগুলো বন্যপ্রাণিদের নিরাপদ আবাসস্থল।
পাহাড়ের ঢালে ঢালে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। নানা রকম গাছপালা সমৃদ্ধ এ উদ্যানে আছে-- সেগুন, চাপালিশ, গর্জন, তেলশুর,জারুল, ছাতিম , চম্পা, সোনালু, চালতা, চিকরাশি, শাল, শিলকড়ই, ধারমারা, গামারি, অর্জুন, আমলকি, আমড়া, বহেরা, বাজনা, বড়ই, পিটরাজ, পিটাল, বাঁশপাতা, বৈলাম, নাগেশ্বর, হিজল, উদল, উরিয়া, লোহাকাঠ ইত্যাদি।বড় বড় বৃক্ষ ছাড়াও এখানে রয়েছে বুনো অর্কিড ও নানা প্রজাতির লতা-গুল্ম। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ। এসব গাছপালার ছায়ার নিচ দিয়ে আঁকাবাঁকা পায়েচলা পথে হাঁটলে মন হারিয়ে যাবে অজানায়।
বৈচিত্র্যময় বন্যপ্রাণীরতে সমৃদ্ধ এ বনাঞ্চল।এখানেই দেখা মিলবে ডাঙ্গার সবচেয়ে বড় প্রাণী বন্যহাতির।
দলবেঁধে হাতিরা বনের ভেতরে ঘুরে বেড়ায় অবাধে। কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের স্তন্যপায়ী প্রাণী মধ্যে আছে বাঁদুড়, বেজি, কাঠবিড়ালি, হরিণ, শেয়াল,হনুমান, উল্লুক, শুকর, বনবিড়াল, গুইশাপ, অজগর ইত্যাদির পদচারণায় মুখর থাকে এ বন। ভাগ্য ভালো থাকলে বিশ্বের অন্যতম বড় বিষধর সাপ শঙ্খচুরের দেখা পেয়ে যেতে পারেন। বিভিন্ন প্রজাতির পাখপাখালির নিরাপদ বিচরণ ক্ষেত্র এই জঙ্গল। ধনেশ, ফিঙ্গে, বুলবুলি, কাঠময়ূর, বনমোরগ, ময়না, ঘুঘু, টিয়া, মাছারাঙ্গাসহ নানান ধরনের পাখির দেখা মিলবে গাছের ডালে, ঝোপের আড়ালে। তবে তাদের দেখতে চাইলে ঠোঁটে কুলুপ এঁটে চলতে হবে বনের পথে। ঋতু ভেদে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে এ মিশ্র চিরসবুজ বন। বেশকিছু দুর্লভ প্রজাতির ব্যাঙেরও দেখা মেলে এখানে। এছাড়া সরীসৃপ প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গিরগিটি, তক্ষক ও সাপ। মনের ভালোলাগা বাড়িয়ে দিতে এ উদ্যানে ওড়াউড়ি করে বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি। রসনা তৃপ্তির জন্য রয়েছে কাপ্তাই লেক ও কর্ণফুলীর ছোট-বড় মাছ। দেখা মিলবে এ উদ্যানে।
বন এলাকা ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির আওতায় বেশ কয়েকটি পর্যবেক্ষণস্থান আর পায়েহাঁটা পথ তৈরি করা হয়েছে এ বনে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও উল্লেখযোগ্য পথটি হল ব্যাঙছড়ির মাঝারি বনপথ। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়কের ব্যাঙছড়ি মারমাপাড়া থেকে শুরু হওয়া বনের ভেতর পথটির দৈর্ঘ্য আড়াই কিলোমিটারের একটু কম। এ পথেই জীববৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশি। রয়েছে বেশ কয়েকটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র এবং টাওয়ার। উঁচুনিচু পাহাড়ি এ পথে আরও আছে ছোটবড় কয়েকটি ঝরনা।
কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান এলাকায় আছে মারমা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের দুটি গ্রাম। একটি ব্যাঙছড়ি মারমাপাড়া অন্যটি চিৎমুরং বড়পাড়া। এসব গ্রামে দেখতে পাবেন তাদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা। তবে গ্রামে প্রবেশের আগে অবশ্যই কারবারি বা হেডম্যানের অনুমতি নিয়ে নিতে হয়।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন কিংবা আকাশপথে চট্টগ্রাম আসতে হবে। এখানে বহদ্দারহাট বাস স্টেশন থেকে পনের মিনিট পরপর বাস ছেড়ে যায় কাপ্তাই এর উদ্দেশ্যে। পৌঁছাতে সময় লাগে দেড়-দুই ঘন্টা। ভাড়া ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকা থেকে সরাসরি কাপ্তাই যায় ডলফিন, সৌদিয়া, এস আলম, শ্যামলী পরিবহনের বাস। ঢাকার কলাবাগান, ফকিরাপুল ও সায়দাবাদ থেকে এসব বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা।
থাকবেন যেখানে
থাকার জন্য রয়েছে সাধারণমানের কিছু হোটেল। কাপ্তাই শহরের এসব হোটেলগুলো হল- হোটেল থ্রি স্টার, হোটেল নিরাপদ, বোয়ালখালি বোর্ডিং, কামাল বোর্ডিং ইত্যাদি। ২০০ থেকে ৬০০ টাকায় দুইজন থাকার কক্ষ আছে। এ ছাড়া বন বিভাগের রেস্ট হাউজে থাকতে হলে পূর্বানুমতির প্রয়োজন হবে। কাপ্তাই এলাকায় খাবার জন্য সাধারণ মানের বেশ কিছু রেঁস্তোরা আছে। সবচেয়ে ভালো খাবারের জন্য বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ঝুম রেঁস্তোরা উৎকৃষ্ট।
জঙ্গল ভ্রমণে করণীয়
সবসময় হালকা কাপড় পরবেন। পোশাকের রংও হবে হালকা। পায়ে পরবেন জুতা। রোদচশমা, রোদটুপি, ছাতা, পানির বোতল সঙ্গে নেবেন। বর্ষায় ভ্রমণে গেলে অবশ্যই ছাতা বা রেইনকোট সঙ্গে নিন। পোকামাকড় আর মশার হাত থেকে বাঁচতে পতঙ্গনাশক ক্রিম নিতে ভুলবেন না। জঙ্গলে বর্ষায় জোঁকের উপদ্রব বাড়ে। তাই জোঁক থেকে বাঁচতে মোজার মধ্যে প্যান্ট গুঁজে নিন। দূরের বন্যপ্রাণী আর পাখি দেখতে দুরবিন নিতে পারেন। জঙ্গলে ভ্রমণের সময় যথাসম্ভব চুপচাপ থাকার চেষ্টা করুন। বেশি আওয়াজে বন্যপ্রাণীরা বিরক্ত হয়। তখন তাদের দেখা পাওয়া কঠিন হবে। প্লাস্টিক জাতীয় প্যাকেট, বোতল, ক্যান সঙ্গে আনলে সেগুলো বনে ফেলে পরিবেশ নষ্ট করবেন না। সঙ্গে করে বাইরে এনে ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলুন।
জঙ্গলে যা করবেন না
পিকনিক করতে জঙ্গলে যাবেন না। ভ্রমণে উচ্চশব্দে বা মাইকে গান কিংবা কোনোকিছু বাজাবেন না। বন্যপ্রাণীরা বিরক্ত হয় এমন কোনো শব্দ কিংবা আওয়াজ করবেন না। ময়লা, প্লাস্টিক জাতীয় কোন কিছু জঙ্গলে ফেলবেন না। বনে ধূমপান করবেন না।
বন্যপ্রাণীদের জন্য কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান দেশের অন্যতম আবাসস্থল হলেও বৈরী জলবায়ুর চেয়ে মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের কারণে বনের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, অধিক বনজসম্পদ আহরণ, জুম চাষ, বন্যপ্রাণী শিকার এর মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছপালা কেটে সেখানে বাণিজ্যিকভিত্তিতে আগর বাগান করার কারণেও বন্যপ্রাণীরা তাদের আবাসস্থল হারাচ্ছে। সংকুচিত হয়ে পড়ছে তাদের বিচরণ এলাকা। পাশাপাশি কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান এলাকার বিভিন্ন স্থানে মানববসতি গড়ে ওঠায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক জীবনধারা। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেই কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান পর্যটকদের কাছে পরিচিত একটি স্থান। এ উদ্যানের সৌন্দর্য অটুট রাখতে এলাকার মানুষের ভেতর সচেতনতা বাড়াতে হবে। পর্যটকদের পরিবেশবিরোধী কার্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখতে হবে এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত। এটি রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় অবস্থিত। এর সর্বমোট আয়তন ৫৪৬৪.০ হেঃ এখানে বনের প্রকৃতি হল ক্রান্তিময় চিরহরিৎ বন। এটি পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের নিয়ন্ত্রনাধীন। জাতীয় উদ্যানটি কাপ্তাই শহর ঘেঁষেই অবস্থিত হওয়ায় এবং এর অপরাপ নৈসিগিক সৌন্দর্য্যরে কারনে প্রতি বছর প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম হয়। স্থানীয় জনগন পরিবহন, বিক্রেতা কিংবা রেষ্টুরেন্টের মাধ্যমে এসব পযটকদের সেবা দানকারী পেশায় নিয়োজিত। ইকো ট্যুরিজমের মাধ্যমে এখানে জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া গৌন বনজদ্রব্য আহরন করে স্থানীয় জনগণ এই জাতীয় উদ্যান থেকে সুবিধা ভোগ করে আসছে। জাতীয় উদ্যানের সংলগ্ন থেকে পার্শ্ববর্তি এলাকার জনসংখ্যা প্রায় ৩০০০।
১৮৭৩,১৮৭৮, এবং ১৮৭৯ সালের ঐতিহাসিক, প্রাচীন, সেগুন বাগান এখানকার ঐতিহ্য। এর সাথে সমন্বয় ঘটেছে উপমহাদেশের আধুনিক বন ব্যবস্থাপনার, এসব বন বাগান এতদিনে প্রাকৃতিক বনের রুপ লাভ করেছে এবং বুনো জীব-বৈচিত্রের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এখানকার উল্লেখ যোগ্য বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েছে, হরিণ, হাতি, বানর এবং বন বিড়াল।
চট্টগ্রাম শহর থেকে বাসে খুব সহজেই কাপ্তাই পৌঁছানো যায়। কাপ্তাই শহরে প্রবেশের পূর্বেই হাতির ভাস্কর্য সহ প্রবেশদ্বার স্বাগত জানাবে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে।
No comments:
Post a Comment