Sunday, February 5, 2017

Lawachara National Park

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান
 বাংলাদেশের বিখ্যাত বনগুলোর মধ্যে লাউয়াছড়ার বন অন্যতম।এটি বাংলাদেশের অবশিষ্ট চিরহরিৎ বনের একটি উল্লেখযোগ্য নমুনা।পরিচিতির দিক থেকে সুন্দরবনের পরেই লাউয়াছড়ার বনের অবস্থান। বাংলাদেশের ৭টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও ১০ টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে লাউয়াছড়া অন্যতম। শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার মৌলভীবাজার ফরেস্ট রেঞ্জের আওতাধীন ২,৭৪০ হেক্টর আয়তনের পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বন ছিলো এলাকাটি, সেই সুবাদে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পূর্ববতী নাম পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বন।১৯১৭ সালের ২০ জানুয়ারি তৎকালীন আসাম সরকারের আসাম ফরেস্ট এটিকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করে। বনের অস্তিত্ব ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি প্রকৃতি ভ্রমণ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পশ্চিম ভানুগাছ বনের ১,২৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৭৪  খ্রিষ্টাব্দের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধন) আইন অনুযায়ী ১৯৯৬  খ্রিস্টাব্দে ৭ জুলাই জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষণা করা হয়।এটি একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল।লাউয়াছড়া বিটের আওতাভুক্ত এই জাতীয় উদ্যান জানকিছড়া ক্যাম্প, লাউয়াছড়া ক্যাম্প ও বাঘমারা ক্যাম্পের সমন্বয়ে পরিচালিত হয়।
  এর মূল অংশ পড়েছে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায়। রাজধানী থেকে ২০০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে এ বনের অবস্থান। সিলেট বিভাগে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় এ বন অবস্থিত।এ এলাকার ভৌগলিক অবস্থানঃ  ২৪°১৯′১১″ উত্তর ৯১°৪৭′১″ পূর্ব
  চিরহরিৎ এ বনে নিরক্ষীয় অঞ্চলের বর্ষাবন বা রেইনফরেষ্টের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। একসময় বৃহত্তর সিলেটের সর্বত্রই এ ধরণের বন ছিলো। তবে বাণিজ্যিকভিত্তিতে চা বাগান সৃষ্টি, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ এবং নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে ক্রমে সংকুচিত হতে হতে মাত্র কয়েকটি স্থানে চিরহরিৎ এ বর্ষাবনের অস্তিত্ব টিকে রয়েছে।
 ভূপ্রকৃতিঃ
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভূপ্রকৃতি পাহাড়ি মৃত্তিকা গঠিত। উঁচু-নিচু টিলা জুড়ে এ বন বিস্তৃত। বনের মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি এবং প্রচুর পাথর দেখা যায়। বনের মাটিতে পাতা জমে জমে পুরু স্পঞ্জের মতো হয়ে থাকে, জায়গায় জায়গার মাটিই দেখা যায় না। এসব স্থানে জোঁকের উপদ্রপ খুব বেশি। বনের ভেতর দিয়ে অনেকগুলো পাহাড়ী ছড়া বয়ে চলেছে। এসব ছড়ার কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলোতে শুধু বর্ষার সময়ই পানি থাকে। ছড়ার পানি পরিষ্কার টলটলে এবং ঠান্ডা। যেসব ছড়াতে শুষ্ক মৌসুমেও পানি থাকে সেসব ছড়ার কাছে বন্যপ্রাণীর আনাগোনা দেখা যায়।নিরক্ষীয় অঞ্চলের চিরহরিৎ রেইন ফরেষ্টের মতো এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সূর্যের আলোর জন্য প্রতিযোগিতা করে এ বনের গাছপালা খুব উঁচু হয়ে থাকে, এবং অনেক ওপরে ডালপালা ছড়িয়ে চাঁদোয়ার মত সৃষ্টি করে। এই বন এতই ঘন যে মাটিতে সূর্যের আলো পড়েনা বললেই চলে।
 জীববৈচিত্র্যঃ 
জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে লাউয়াছড়ার জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের সমৃদ্ধতম বনগুলোর একটি। আয়তনে ছোট হলেও এ বন দুর্লভ উদ্ভিদ এবং প্রানীর এক জীবন্ত সংগ্রহশালা। বনে প্রবেশের সাথে সাথেই নানা ধরনের বন্যপ্রাণী, পাখি এবং কীটপতঙ্গের শব্দ শোনা যায়। বনের মধ্যে প্রায় সারাক্ষণই সাইরেনের মত শব্দ হতে থাকে; প্রকৃতপক্ষে এটি এক ধরণের ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ।

 লাউয়াছড়ার বন্যপ্রাণীর মধ্যে ২৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী রয়েছে। এরমধ্যে ছয় ধরনের বানর জাতীয় প্রাণী- উল্লুক, লজ্জাবতী বানর, ক্যাপড্ লেংগুর, পিগ টেইল ম্যাকাক, ফ্যারিজ লিফ মাংকি ও সাধারণ বানর। রয়েছে মায়া হরিণ, কমলা বুকওলা কাঠবিড়ালি, শেয়াল, মেছো বিড়াল, বন্যশূকর, সজারু, সিভেট, জংলী বিড়াল, বেজী ইত্যাদি।
২৯ প্রজাতির সরীসৃপ, যার মধ্যে অজগর, গোখরা, পিট ভাইপার ও মনিটর লিজার্ড উল্লেখযোগ্য। ছয় প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে এ বনে স্তন্যপায়ী আছে নানা প্রজাতির। বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য এ বন বিখ্যাত। বনের মধ্যে কিছু সময় কাটালেই উল্লুকের ডাকাডাকি কানে আসবে। লাউয়াছড়ার বনেই রয়েছে বিপন্ন প্রজাতির উল্লুক (Hoolock Gibbon)। বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে এ উল্লুক বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। লাউয়াছড়ার বনেও এদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। দুই দশক আগে এই বনে কয়েক হাজার উল্লুক দেখা যেতো। কিন্তু বর্তমানে সে সংখ্যা কমতে কমতে একশোরও নিচে এসে ঠেকেছে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে একসময় হয়তো এই বন থেকে উল্লুক চিরতরে হারিয়ে যাবে। নির্বিচারে বন ধ্বংসের ফলে উল্লুকের বাসস্থান ও খাদ্যসংকট সৃষ্টিই এদের সংখ্যা হ্রাসের প্রধানতম কারণ। লাউয়াছড়ার বনে বর্তমানে মাত্র ৪৯ টি উল্লুক অবশিষ্ট আছে। নিকটবতী ছাউতলি ও কালাছড়ার বন মিলিয়ে এ সংখ্যা ৬০-এর মত। লাউয়াছড়া ও এর আশপাশের বনে মোট ১৬ টি উল্লুক পরিবার রয়েছে।ভোরবেলা লাউয়াছড়ার বনে গেলে অনেক সময় উল্লুকের দেখা পাওয়া যায়।এই বনে উল্লুকের প্রিয় খাদ্য চাপালিশ ফল।উল্লুকছারাউ এখানে রয়েছে মুখপোড়া হনূমান, বানর, সিয়াল,মেছোবাঘ , বন্য কুকুর, ভাল্লুক, মায়া হরিন  নানা প্রজাতির জীবজন্তু। মায়া হরিণ সাধারণত উচ্চতায় ২০‌-২২ ইঞ্চি। এদের বাদামী রঙের দেহ যা পিঠের দিকে ঘিয়ে গাঢ় রং ধারণ করে।
এ বনে সরীসৃপ আছে নানা প্রজাতির। তার ভেতর অজগর হচ্ছে অনন্য। এখানে পাওয়া যায় হলুদ পাহাড়ি কাছিম
উদ্যানের বন্য পাখির মধ্যে সবুজ ঘুঘু,বনমোরগ, তুর্কি বাজ, সাদা ভ্রু সাতভায়লা, ঈগল, হরিয়াল,কালোমাথা টিয়া, কালো ফর্কটেইল. ধূসর সাত শৈলী,পেঁচা , ফিঙে, লেজকাটা টিয়া, কালোবাজ, হীরামন, কালোমাথা বুলবুল,ধুমকল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সাধারণ দর্শনীয় পাখির মধ্যে টিয়া, ছোট হরিয়াল, সবুজ সুইচোরা, তোতা , ছোট ফিঙ্গে, সবুজ কোকিল,পাঙ্গা, কেশরাজ প্রভৃতির দেখা মিলে।এই বনে রয়েছে ২৪৬ প্রজাতির পাখি। উল্লেখযোগ্য হলো পাহাড়ি ময়না, ধনেশ, মথুরা, বন মোরগ, ব্যবলার, লাফিং থ্রাস, বারবেট, পেঁচা, সবুজ ঘুঘু ও বক। লাউয়াছড়া বনে বিশেষ এক ধরেনের জোঁক আছে। এরা যে স্থানে থাকে সেই স্থানের রং ধারণ করে। এছাড়া রয়েছে পাহাড়ি সোনালী কচ্ছপ। ১৬০টিরও বেশি প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে বলে বন বিভাগের তথ্য থেকে জানা যায়।


উদ্ভিদবৈচিত্র্যঃ
লাউয়াছড়া বনাঞ্চলে রযেছে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ।এর মধ্যে অনেক দুর্লভ প্রজাতির উদ্ভিদও রয়েছে।  উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদের মধ্যে  গর্জন,সেগুন,গামার,মেনজিয়াম, জাম্রুল,চাপালিশ, নাগেশ্বর, শিমুল,কদম, লোহাকাঠ, জারুল, বট, পাকুড়, ডুমুর, বহেরা, আমলকি, হরিতকি, জাম,আম, কাঁঠাল, ডুমুর, তুন, কড়ই,ছাতিয়ান, রক্তন  প্রভৃতি বৃক্ষ ছাড়াও আওয়াল, বনাকসহ নানা জাতের স্থানীয় প্রজাতির গাছ দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশে নানা ধরণের অর্কিড  দেখতে হলেও এ বন এক অপূর্ব স্থান। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার সেগুন, লোহাকাঠ, চাপালিশ, জারুল, কদমসহ নানা মূল্যবান গাছের চারা রোপন করে যা এখনো মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে এই বনে ।  এশিয়ার মধ্যে শুধু লাউয়াছড়া বনেই দুইটি ‘আফ্রিকান টিক ওক’ গাছ দেখা গেছে। ইতিমধ্যে ঝড়ে একটি গাছ পড়ে গেছে। লাউয়াছড়া বিট অফিসের পাশে অপরটি রয়েছে।
নিসর্গ প্রকল্প ও প্রকৃতি ভ্রমনঃ 
লাউয়াছড়ার ট্রেইলে
নিসর্গ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য স্থানীয় জনগণ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষগুলোর সাথে বন বিভাগের অংশীদারিত্বের সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সুষ্ঠ সংরক্ষণ ও ব্যবস্হাপনা। বর্তমানে ইউ এস এ আই ডি(USAID) -এর আর্থিক সহযোগীতায় দেশের ১৭টি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এই প্রকল্প চালু আছে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানও এই প্রকল্পের অর্ন্তভুক্ত।নিসর্গ প্রকল্পের অধীনে লাউয়াছড়া বনের রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার কাজে স্থানীয় জনগনকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এর ফলে বনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং বনের সংরক্ষণে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রকৃতি ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নির্দিষ্ট হারে প্রবেশ মূল্য দিয়ে এ বনের ভেতর প্রকৃতি ভ্রমণ করা যায়। প্রকৃতি ভ্রমণের জন্য বনে তিনটি ট্রেইল বা হাঁটা পথ রয়েছে। তিনটি পথের মধ্যে একটি ৩ ঘণ্টার পথ, একটি ১ ঘণ্টার পথ আর অপরটি ৩০ মিনিটের পথ। প্রশিক্ষিত গাইডের সহায়তায় বনের একেবারে ভেতর পর্যন্ত যাওয়া যায়। প্রকৃতিকে বিরক্ত না করে তৈরি করা এ তিনটি পথে চোখে পড়বে নানা প্রজাতির কীটপতঙ্গ ,গাছপালা,পাখি ও অর্কিড । ভাগ্য ভালো হলে হনূমান , বানর এবং উল্লুকেরও দেখা মিলতে পারে। দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক প্রতিদিন লাউয়াছড়ায় প্রকৃতি ভ্রমনে  আসেন। বছরজুড়েই এই বনে পর্যটকদের আনাগোনা থাকলেও শীতের সময় সবচেয়ে বেশি লোকসমাগম হয়। 

আদিবাসী নৃগোষ্ঠীঃ 
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাশেই রয়েছে মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি । খাসিয়ারা বন ও প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে গড়ে তুলেছে তাদের আবাস। তাদের আবাসভূমিগুলো একাধিক টিলা অতিক্রম করে উঠে গেছে ছোট ছোট টিলার উপরে। তাদের প্রধান পেশা পান চাষ। জানকিরছড়ার ডলুবাড়িতে রয়েছে ত্রিপুরা আদিবাসীর বসতি।এইখানে কিছু মনিপুর সম্প্রদায়ও রয়েছে।  


হলিউডের চলচ্চিত্রের শুটিং

জুলভার্নের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে করা 'অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ' ছবিটির একটি দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল এই বনে। ১৩টি দেশের ১১৪টি লোকেশনে চিত্রায়িত হয় ছবিটি। এসব দেশের মধ্যে ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ভারত, বাংলাদেশ. স্পেন, থাইল্যান্ড ও জাপান। আর বাংলাদেশের অংশের শুটিং হয়েছিল সিলেটের লাউয়াছড়া জঙ্গলে। বন ঘেঁষে যে রেলপথ চলে গেছে, ঠিক সেখানেই হয়েছে ছবিটির কিছু দৃশ্যের শুটিং। ছবিটির একটি দৃশ্য ছিল এ রকম_ট্রেন ছুটছে। হঠাৎ চালক খেয়াল করলেন, লাইনের সামনে একপাল হাতি আপনমনে চড়ে বেড়াচ্ছে। ট্রেন থেমে যায়। কামরা থেকে নেমে আসেন নায়ক ডেভিড নিভেন, ব্যাপারটা কী দেখতে। সামনের গ্রামেই তখন হচ্ছিল সতীদাহ। নায়ক ছুটে গিয়ে মেয়েটিকে বাঁচান। মেয়েটি হলো শার্লি ম্যাক্লেইন। ছবির এই অংশটুকুই চিত্রায়িত হয়েছিল লাউয়াছড়ার রেললাইন এলাকায়।
 জীববৈচিত্র্য, উদ্ভিদবৈচিত্র্য ও পরিবেশ বিপর্যয়
গ্যাস অনুসন্ধান ও এর ফলে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়ঃ
পরিবেশবাদী ও সচেতন মহলের ব্যাপক প্রতিবাদসত্ত্বেও ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানী শেভরন  লাউয়াছড়া ও এর আশেপাশের বনভূমি এলাকায় ত্রিমাত্রিক অনুসন্ধান শুরু করে। ত্রিমাত্রিক অনুসন্ধানের জন্য বনের অভ্যন্তর ও আশপাশের এলাকায় নির্বিচারে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এসময় বন এলাকায় সৃষ্ট ভূকম্পনে বন্যপ্রাণী ও স্হানীয় লোকজন আতঙ্কিত হযে পড়ে, বনের কয়েক জায়গায় আগুন ধরে যায়, বনের আশপাশের বাড়িঘরে ফাটল দেখা দেয়। লাউয়াছড়া বনে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অনুসন্ধানের অনুমতি প্রদানের জন্য তৎকালীন  তত্ত্বাবধায়ক সরকারও দেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। এর আগে ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে আরেক বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানীদেন্তাডেন্টালপরিচালিত এধরণের একটি অনুসন্ধানের সময় লাউয়াছড়া বনের পাশেই মাগুরছড়ায় অনুসন্ধান কুপে ভয়াবহ গ্যাস বিস্ফোরণে পুরো এলাকায় মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে এবং পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়।এ বিস্ফোরণের ফলে কয়েক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে যায়। মাগুরছড়ার বন এখনও সেই ক্ষত বহন করছে। মাগুরছড়া বিস্ফোরণে বাংলাদেশ সরকার ওই কোম্পানীর কাছে ক্ষতিপূরণ দাবী করলেও তা এখনো অমিমাংসীত পর্যায়ে রয়ে গেছে।
 বর্তমানে লাউয়াছড়ার প্রধান শত্রু হলো ভূমি দখল, বৃক্ষ উজার, বনের ভিতর দিয়ে যাওয়া রেল লাইন, পাকা সড়ক ও খোলা বৈদুতিক লাইন।
ট্রেনের শব্দ বনের পরিবেশ দূষণ করে এবং ট্রেনে কাটা পড়ে প্রায় সময়ই বিভিন্ন প্রাণীর মৃত্যু হয়। এছাড়া রেল লাইনের পাশের বৃক্ষগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলে ট্রেন লাইনের পাশের গাছগুলো কাটতে হয়।
একই অবস্থা বনের ভিতর দিয়ে যাওয়া শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়কেও। প্রতিনিয়ত গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা পড়ছে মায়া হরিণ, মেছোবাঘ, সাপ, হিমালয়ান পাম সিভেট, গন্ধগকুলসহ বিভিন্ন প্রাণী।
আর ৩৩ হাজার কেভির বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে প্রায় সময়ই মারা যায় বিপন্ন প্রাণী উল্লুক, হনুমান ও বিভিন্ন প্রজাতির বানর।
  লাউয়াছড়া বনে বসবাসকারী মাগুরছড়া পুঞ্জির মন্ত্রী জিডিসন প্রধান সুচিয়াং বলেন, বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায়ই বন ধ্বংস হচ্ছে। এখনও যেখানে বন আছে তার অধিকাংশ এলাকায়ই খাসিয়াদের বাস। তাই বলা চলে খাসিয়া ও আদিবাসীদের কারণেই এখনও কিছু কিছু বন টিকে আছে। খাসিয়ারা প্রকৃতিবান্ধব, তাই খাসিয়া দ্বারা বন ধ্বংস হয় না বন রক্ষা হয়।
লাউয়াছড়া সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মোছাদ্দেক আহমদ মানিক বলেন, বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বনবিভাগের পাশাপাশি তারাও কাজ করছেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন উদ্বুদ্ধকরণ সভা, অতিরিক্ত পাহারাদার নিযুক্তি, পর্যটকদের শৃঙ্খলা আনয়নসহ বিভিন্ন কাজ তারা করছেন। বনের ভিতর বেশকিছু ফলজ বৃক্ষের চারাও রোপন করেছেন।
সাংসদ আব্দুস শহীদ বলেন, লাউয়াছড়া বন রক্ষা করতে সরকারের পাশাপাশি এর চারপাশের জনগণকেও সচেতন হতে হবে।
শ্রীমঙ্গল পৌর মেয়র মহসীন মিয়া মধু ও কমলগঞ্জ পৌর মেয়র জুয়েল আহমদ বলেন, লাউয়াছড়া বনের কারণে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জে হাজার হাজার পর্যটক আসেন। এ দুই উপজেলা আজ সারাদেশে এ কারণে পরিচিত। এর সুবাদে দুই উপজেলায় গড়ে উঠেছে শত শত রিসোর্ট ও পর্যটন নির্ভর ব্যবসা।
 বনের ভিতরে পানি ও প্রয়োজনীয় খাবারের অভাবে প্রায়ই বিভিন্ন প্রাণী বন থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে চলে আসে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব প্রাণী মানুষের হাতে মারা যায় কিংবা আহত হয়। এমন প্রাণীদের সেবাশুশ্রূষা করেন এবং আবার বনে অবমুক্ত করেন পরিবেশবিদ সিতেশ রঞ্জন দেব।
বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সিতেশ রঞ্জন দেব বলেন, চোখের সামনেই পাল্টে গেছে এই বন। এই বনেই তিনি দেখেছেন ভাল্লুক, চিতা বাঘ, মেছো বাঘ, সজারু, বন রুইসহ অসংখ্য প্রাণী। আজ বনের ভিতরে প্রবেশ করলে আর কিছুই দেখা যায় না।
এর কারণ হিসেবে তিনি দেখছেন গাছ কমে যাওয়া এবং এর ফলে বনের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত ছড়াগুলো দিয়ে পানির প্রবাহ কমে যাওয়া। বন্যপ্রাণীর খাবারের জন্য যে বৃক্ষ ও ছোট ছোট কীটপতঙ্গ তাও নেই। তাই প্রাণীরা বিপন্ন তো হবেই।
বহু প্রাণী তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করে এই বনে অবমুক্ত করেছেন এবং এখনও করেন।

No comments:

Post a Comment