Sunday, February 5, 2017

Singra National Park

সিংড়া জাতীয় উদ্যান
 উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল।স্থানীয়ভাবে এটি সিংড়া শালবন নামে পরিচিত।সিংড়া বনকে ১৮৮৫ সালে অধিভুক্ত করা হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে বনবিভাগের অধীনে নিয়ে গেজেট প্রকাশ হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়ন, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ এবং পর্যটন সুবিধার উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর বনবিভাগ এটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। এই বনভূমির মোট আয়তন ৩৫৫ হেক্টর এবং এর মধ্যে জাতীয় উদ্যানের পরিমাণ (সংরক্ষণ) ৩০৫.৬৯ হেক্টর। ডালাগ্রাম, চাউলিয়া, সিংড়া ও নর্তনদী এ ৪টি মৌজায় সিংড়া জাতীয় উদ্যান বিস্তৃত।
 দিনাজপুর জেলা শহর থেকে সড়ক পথে ৪০ কিঃমিঃ উত্তরে বীরগঞ্জ উপজেলা থেকে ১৫ কিঃমিঃ দূরে ভোগনগর ইউনিয়নে এর অবস্থান। এ এলাকার ভৌগলিক অবস্থানঃ ২৫°৫৩′২৪″উত্তর ৮৮°৩৩′৪৭″পূর্ব
 সিংড়া জাতীয় উদ্যানের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে নর্ত নদী। পর্যটকদের সুবিধার্থে এখানে একটি ছোট পরিসরের রেস্ট হাউজ ও দুটি পিকনিক স্পট রয়েছে। শীত মৌসুমে এই বনে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যায়। সিংড়া শালবনের জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে আরডিআরএস বাংলাদেশ এর সহযোগীতায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি কাজ করছে।

সিংড়া জাতীয় উদ্যানে মূলত পত্রঝরা শালবৃক্ষের প্রাধান্য দেখা যায়।এটি একটি প্রাকৃতিক শালবন। তবে শাল ছাড়াও এখানে জারুল, তরুল, শিলকড়ই, শিমুল, মিনজিরি, সেগুন, গামার, আকাশমনি, ঘোড়ানিম, সোনালু, গুটিজাম, হরতকি, বয়রা, আমলকি এবং বিভিন্ন ধরনের নাম না জানা উদ্ভিদ ও লতা-গুল্ম রয়েছে।
 এক সময়ে এই বনে বাঘ, নীল গাইসহ  বিভিন্ন প্রজাতির বন্য জীবজন্তুর আবাস ছিল। তবে বনভূমি ধ্বংস ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে এ বনভূমি থেকে জীবজন্তু হারিয়ে যেতে থাকে। বর্তমানে এই বনে বন বিড়াল,মেছোবাঘ,খরগোশ, শিয়াল, গুই সাপ, সাপ, বেজি সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও পতঙ্গের দেখা পাওয়া যায়। শিয়ালের জন্য খুবেই বিখ্যাত সিংড়া জাতীয় উদ্যান।
 যুগযুগ ধরে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠা এই শালবন তথা জাতীয় উদ্যানটি এখন সমগ্র উত্তরবঙ্গের মানুষের জন্য একটি আকর্ষনীয় পর্যটন স্পট। সারি সারি আকাশ ছোঁয়া দীর্ঘ সুউচ্চ শাল গাছের সবুজ আচ্ছাদন পর্যটকদের দুরথেকে যেন হাতছানি দিয়ে ডেকে যায় যা উপেক্ষা করা যে কোন পর্যটকের জন্য কষ্টসাধ্য। সবুজের বুক চিরে তার মাঝ দিয়ে বয়ে চলা পূর্ননভা নদী এই জাতীয় উদ্যানটির সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে দিয়েছে আরও শতগুন। পূর্ননভা নদীর কুলকুল ধ্বনি এবং অবিরাম বয়ে চলা শীতল জলধারা যেকোন ক্লান্ত, শ্রান্ত পর্যটকমনকে শীতল করে দেয় মূহুর্তেই। নদীর তীর ধরে বনের মধ্য কিছুদুর গেলেই চোখে পড়বে আদিবাসী সাঁওতাল পুরুষ-রমনীদের চাঁই অথবা জাল দিয়ে নদীর ছোট ছোট মাছ ধরার চমৎকার দৃশ্য। এটি হতে পারে পর্যটকদের জন্য একটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক দৃশ্য। বনের অভ্যন্তরে সিংড়া মৌজায় রয়েছে একটি বহুপুরাতন খ্রীষ্টান মিশন। এটি প্রতিষ্ঠা করেন ফাদার এনজো কর্বা নামের একজন খ্রীষ্টান পাদ্রী যিনি ইতালীয় নাগরিক ছিলেন। তিনি খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দ্যেশ্যে বাংলাদেশে আগমন করেন এবং সম্ভবত ১৯৩০ সালের দিকে এদেশে এসে এই স্থানে এই মিশনটি প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুর পর মিশনের সামনে তাকে সমাহিত করা হয়। এখানে ধ্যান করার জন্য চমৎকার বাংলো বাড়ী রয়েছে এবং প্রতি সপ্তাহে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। এই মিশনটি ও এখন পর্যটকদের আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু। বনে অভ্যন্তরে রয়েছে একটি বড় পুকুর যা কালের সাক্ষী হয়ে ও তৎকালীন জমিদারদের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে আজও টিকে আছে। এছাড়াও বনের মধ্যে রয়েছে বড় বড় উঁইপোকার মাটি দিয়ে তৈরী ঢিবি, লম্বা লম্বা গিলা লতা যা দেখে আপনারও নিজেকে ছোটকালে দেখা “টারজন”হয়ে এক গাছ হতে আরেক গাছে যেতে ইচ্ছে করবে। আপনি যদি সৌন্দর্য্য পিপাসু, প্রকৃতি প্রেমী কিংবা প্রাচীন নিদর্শন দেখতে ভালবাসেন এবং সেই সাথে গ্রামীন আবহে অত্যন্ত কাছ থেকে আদীবাসীদের জীবন যাত্রা দেখতে চান তাহলে আর দেরী না করে ব্যাগ গুছিয়ে আজই বের হয়ে পড়তে পারেন সিংড়া জাতীয় উদ্যানের উদ্দেশ্যে। যে স্থানটি প্রতিবছর শীত মৌসুমে হাজার হাজার পর্যটকদের পদচারনায় মুখর হয়ে থাকে। এখানে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকেরা শিক্ষা সফরে আসে, বিভিন্ন বানিজ্যিক ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বনভোজন, পারিবারিক ট্যুর ও নব-দম্পতিদের ঘুরতে আসা উল্লেখযোগ্য। তাই পরিকল্পনা করে বের হয়ে পড়তে পারেন আর আপনিও হতে পারেন সেই সৌভাগ্যবান হাজার হাজার পর্যটকদের একজন। পরিকল্পনা করার সময় অবশ্যই মনে রাখবেন আপনি যদি বনভোজন উৎসব করতে চান তাহলে আপনাকে আসতে হবে শীতকালে। আপনি যদি বনের সবুজময় ভরা যৌবন ও নদীর উচ্চলতা দেখতে চান তাহলে আপনাকে আসতে হবে ঘোর বর্ষাকালে।

No comments:

Post a Comment